
যুদ্ধ মানে শত্রু শত্রু খেলা, আমার প্রতি তোমার অবহেলা! যুদ্ধ, নির্মলেন্দু গুণের বিখ্যাত কবিতাগুলোর একটি। ইউক্রেন ইস্যুতে নতুন যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা শুরু হয়েছে পৃথিবীর একটি এলাকায়। অস্ট্রেলিয়ায় আমরা এটা টের পাচ্ছি জ্বালানি তেলের দাম থেকে।
জ্বালানি তেল পেট্রোলের দাম এখানে দীর্ঘদিন লিটার প্রতি দেড় ডলারের কম ছিল সেটি এলাকা ভেদে এখন প্রতি লিটার এখন দুই ডলার ছুঁই ছুঁই! অস্ট্রেলিয়ায় জ্বালানি তেলের দাম নিয়ে আবার মজার একটি বাস্তবতা আছে। যা এই সুযোগে শেয়ার করে নেই।
এদেশের সিংহভাগ ব্যবসায়ীদের মধ্যে সততা আর আইনানুগ চলার প্রবনতার পাশাপাশি কম লাভে বেশি বিক্রির ঝোঁকও আছে। এরজন্যে দেখা যাবে তেলের দাম এক পেট্রোল পাম্পের নিয়ন সাইনে জ্বলছে একেক রকম! আমরাও তাই পথ চলতে চলতে জেনে যাই কোথায় দাম কম বা বেশি।
যেমন আমি যে সস্তা তেলের পাম্পে তেল কিনি সেখানে প্রতি লিটার এখনও ১ ডলার ৬৩ সেন্ট। একই তেল কাছাকাছি আরেক পাম্পে ১ ডলার ৯৩ সেন্ট বা এরচেয়ে বেশি। তেলের দাম এখানে অনেক ক্ষেত্রে তৎকালীন ক্রয়মূল্য, পাম্পের কর্মচারীর বেতন, রক্ষণাবেক্ষন ব্যয়ের ওপরও নির্ভরশীল।
এদেশের পাম্পে তেল দেবার কোন কর্মচারী নেই। তেল সবাই যার যার মতো করে গাড়িতে নিয়ে, এরপর কাউন্টারে গিয়ে দাম পরিশোধ করেন। মন্ত্রী-এমপি সবাই এমন যার যার গাড়ির তেল নিজেরাই ভরে নেন। কাউন্টারে দাম বুঝে নেবার জন্যে থাকেন পাম্পের একমাত্র কর্মচারী।
তিনিই পাম্পের রিসেপশনিস্ট। পাম্প মানে এদেশে ছোটখাটো বিপনি বিতান, দুধ-চা-কফি থেকে শুরু করে রিডিং গ্লাস-মোবাইল ফোনের চার্জার সহ নানাকিছু এখানে কিনতে পাওয়া যায়। বিপনি বিতানের সব মালামাল সাজানো সহ সব পাম্পের একমাত্র কর্মচারীই দেখভাল তিনিই করেন।
ইউক্রেন সংকট নিয়েও অস্ট্রেলিয়া আমেরিকার পক্ষ নিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া এমন একটি দেশ যার ভৌগলিক অবস্থান এশিয়ায় হলেও ইউরোপের সঙ্গে থাকতে ভালোবাসে। কারন এদেশের নেতৃত্বের পূর্ব-পুরুষরা ইউরোপ থেকে এসেই আদিবাসীদের দেশ অস্ট্রেলিয়া দখল করেছে।
আর ইউরোপের সব দেশের মতো অস্ট্রেলিয়াও আন্তর্জাতিক নানান ইস্যুতে দৌড়ে চটজলদি আমেরিকার পক্ষ নেয়। অনেকটা পক্ষ নিতে দেরি হয়ে গেলো কিনা সে টেনশনেও যেন থাকে। তবে ইউক্রেন ইস্যুতে এখনই অস্ট্রেলিয়ার বাজারের ভোগ্যপণ্য চাল-ডাল-আটা-রুটি-কফির দাম বাড়েনি বা বেড়ে যাবেনা।
যে ঝুঁকি বাংলাদেশে বেশি। রোজার চাঁদ দেখা যাবার দুই মাস আগে থেকে বাংলাদেশের অসৎ ব্যবসায়ীরা বিসমিল্লাহ বলে রোজা ভিত্তিক দাম বাড়াতে শুরু করে দেয়! এদের সিংহভাগ আবার ধর্মভীরু! তারাবির নামাজ পড়ে তারা রোজাও রাখেন। রোজাদার খদ্দেরদের শুষে নিয়ে বাড়তি মুনাফার টাকায় জাকাতের শাড়িও বেশি বিলান!
বাংলাদেশের সরকার-বানিজ্যমন্ত্রী-মন্ত্রনালয়ও এসব অসৎ ব্যবসায়ীদের পক্ষ নেন। ইউক্রেন ইস্যুর আগেই ব্রাজিলে দাম বেড়েছে এই ইস্যুতে বাংলাদেশে সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে। বানিজ্যমন্ত্রীও তাদেরকে এই সার্টিফিকেট দিয়েছেন! আর বলেছেন, সরকারের এ নিয়ে কিছু করার নেই!
এখন ইউক্রেন আর রোজার ইস্যুতেও বাংলাদেশের ভোগ্যপণ্যের দাম আরও বাড়বে। বাংলাদেশের সংসদ সদস্যদের বেশিরভাগ যেহেতু এখন ফড়িয়া ব্যবসায়ী অথবা তাদের পোষ্য, তাই তারা নানান ভাবে দেশের মানুষের জীবন অতিষ্ট করা অসৎ ব্যবসায়ীদের পক্ষ নিতে তাদের বিবেকে বাঁধে না।
তাদের লাজ হয়না টিসিবির পণ্য কিনতে হাপিত্যেশ করা অভাগা মানুষের লাইনের ছবিতে! কারন এই সদস্যরা তাদের ভোটে নির্বাচিত নন। ভোটের জন্যে তারা তাদের কাছে যাবেনওনা। এখনো ইউক্রেন ইস্যুতে বাংলাদেশ যে আমেরিকার পিছনে লাইনে দাঁড়ায়নি এটা ভালো একটা দিক।
কারন এখানে বাংলাদেশের কোন স্বার্থ নেই। রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পও এর কারন হতে পারে। আমেরিকা-ন্যাটো জোট ইউক্রেনের জন্যে কাঁদছে কারন তারা সেখানে অস্ত্র বিক্রি করতে চায়। বাংলাদেশ অস্ত্র উৎপাদনকারী-বিক্রেতা কোন দেশ নয়।
বুধবার রাতে একাত্তর টিভি ইউক্রেন ইস্যুতে বিশেষজ্ঞ মতামত নিতে এক ব্যক্তিকে আমন্ত্রন করে এনেছিল। ভদ্র যে আমেরিকার একজন খাস বান্দা তা একদম লুকোননি। তার মতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আমেরিকা-ন্যাটোভূক্ত দেশগুলো দারুন একটা কাজ করেছে!
এতেই নাকি রাশিয়ার অর্থনীতি ধসে পড়বে! আমেরিকা-রাশিয়া এদের কেউ ফেরেশতা রাষ্ট্র নয়। রাশিয়া নিজের স্বার্থে ইউক্রেনের ন্যাটোভূক্তির বিরোধিতা করছে। আমেরিকা-ন্যাটোভূক্ত দেশগুলো নিজস্ব স্বার্থে পক্ষ নিয়েছে ইউক্রেনের।
আর একাত্তর টিভিতে আসা ভদ্রলোক আমেরিকার পক্ষ নিতে গিয়ে অনাবশ্যক বাংলাদেশ-ভারত ইস্যুকে টেনে এনেছেন! টেনে এনেছেন শামীম ওসমান ইস্যু!
পূর্ব ইউক্রনের দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন প্রজাতন্ত্রের স্বীকৃতি দেয়াকে তিনি প্রশ্ন তুলে বলেছেন, এখন যদি ভারত বাংলাদেশকে দখল করে নেয় তাহলে কি দাঁড়াবে! পূর্ব ইউক্রনের দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক এতদিন রুশপন্থীদের দখলে ছিল। পশ্চিমা মিডিয়া যাদের বরাবর বলে আসছে বিচ্ছিন্নতাবাদী!
যেমন একাত্তরে আমরা যখন ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনে স্বাধীনতা যুদ্ধ করছিলাম তখনও পাকিস্তানপন্থী পশ্চিমা মিডিয়া আমাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী বলছিল। তাদের কথা শুনলে কি আমরা বাংলাদেশ স্বাধীন করতে পারতাম?
একাত্তর টিভিতে আসা ‘বিশেষজ্ঞ ভদ্রলোক’ কি কারনে পূর্ব ইউক্রনের দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক ইস্যুকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সঙ্গে তুলনা করলেন তা দিন শেষে বোধগম্য। একই মনন থেকে তিনি নিজেকে প্রকাশ করে বলেছেন, ‘শামীম ওসমান যদি নারায়নগঞ্জকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষনা করেন’!
তিনি অবশ্য পরে বলেছেন, ‘শামীম ওসমান বুদ্ধিমান, তাই এমন কিছু করবেননা’। ভদ্রলোক হয়তো মার্কিনপন্থী বিশেষজ্ঞ হিসাবে ভালো। কিন্তু ভুল উদাহরন ব্যবহার করতে গিয়ে নিজেকে প্রকাশ করে ফেলেছেন। যুদ্ধ এমন নানান স্টকহোল্ডারদের স্বরূপও প্রকাশ করে।
ইউক্রেনে থাকা এক বাংলাদেশি ছাত্রকে একাত্তর জার্নালে সংযুক্ত করা হয়েছিল। তার কথায় জানা গেলো প্রায় দেড়-দুই হাজার বাংলাদেশি ইউক্রেনে আছেন। ইউক্রেনে বাংলাদেশের দূতাবাস নেই। পোলান্ডের বাংলাদেশ দূতাবাস তাদের দেখভাল করে।
পোলান্ড দূতাবাস ইউক্রেনে থাকা বাংলাদেশীদের দেশে ফিরতে অথবা পোলান্ডে চলে যেতে বলেছে। আমার মনে হয় এই পরামর্শও সর্বাংশে কাজে দেবেনা। লেবাননে সর্বশেষ হিজবুল্লাহ-ইসরাইল যুদ্ধের রিপোর্ট করতে গিয়ে আমি তেমন এক বাস্তবতা সরেজমিন দেখেছি।
সেই যুদ্ধে ভীতসন্ত্রস্ত বাংলাদেশীদের অনেকে জাতিসংঘের ব্যবস্থাপনায় জর্দান হয়ে দেশে ফিরছিলেন। কিন্তু বৈরুত পৌঁছে দেখি অনেক বাংলাদেশীই সেখানকার পরিস্থিতি মানিয়ে নিয়ে যুদ্ধ পরিস্থিতি স্বত্ত্বেও সেখানে অবস্থানের পক্ষে। কারন দেশে ফিরে টিকে থাকাও তাদের আরেক যুদ্ধের নাম!
লেবাননের সেই বাংলাদেশীদের. অনেকে তুরস্ক-গ্রীস হয়ে ইউরোপ যাবার আশায় লেবাননে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে থিতু হতে পারায় সে দেশেই থেকে যান। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে দেশে যাবার ব্যয়ের ঝক্কি তারা এড়াতে চেয়েছেন। অনেকের আবার দেশে ফিরলে ভিসা জটিলতায় লেবাননে আর ফেরা হবেনা।
এভাবে ইউক্রেনে যদি দেড়-দুই হাজার বাংলাদেশী থেকে থাকেন তাদের সিংহভাগ নিঃসন্দেহে অন্যদেশে যাবার আশায় ইউক্রেন গিয়েছিলেন। এখন দেশে ফেরা অথবা পোলান্ড যাওয়া মানে তাদের নতুন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়া। দেশেবিদেশে সব জায়গাতেই টিকে থাকা মানেই তাদের কাছে যুদ্ধ।
সিংহভাগ বাংলাদেশী এভাবেইতো বিদেশে যান। এভাবেইতো রেমিটেন্স দেশে পাঠান। কাজেই ইউক্রেন পরিস্থিতিও বাংলাদেশকে সবদিক বিবেচনায় রেখে সামাল দিতে হবে। বঙ্গবন্ধুর বিদেশনীতি ছিল সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব। আমেরিকা-রাশিয়ার কর্তৃত্বের দ্বন্দ্বে আমরা যাতে কারো শিখন্ডি হয়ে না দাঁড়াই।