প্রিয় প্রজন্ম || Priyo Projonmo

লালসবুজ পতাকা উড়ছে মঙ্গানুইর পাহাড়ের চূড়ায়

ফজলুল বারী

প্রকাশিত: ২৩:৩১, ৩ জানুয়ারি ২০২২

লালসবুজ পতাকা উড়ছে মঙ্গানুইর পাহাড়ের চূড়ায়

নীল ওয়াগনার আর মমিনুল হক। ছবিঃ অনলাইন

মঙ্গানুইর পাহাড়ের চূড়ায় এখনও উড্ডিন বাংলাদেশের লালসবুজ পতাকা! কথাটা অনেকের পছন্দ না হতেও পারে। এর আগের লেখায় লিখেছি বাংলাদেশের সামান্য সম্ভাবনার সুযোগ থাকতেই আমি তা লিখে ফেলি। মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টের তৃতীয় দিনটিও বাংলাদেশের জন্যে স্বপ্নের মতো কেটেছে।

খেলার চতুর্থ-পঞ্চম দিনে কি ঘটবে তা আমরা জানিনা। অতীতের অভিজ্ঞতা আমাদের ভালো নয়। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে এমন আলো ছড়ানো আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল ২০০৪ সালে ব্রায়ান লারাদের ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে! মোহাম্মদ রফিক সেই খেলায় অবিস্মরনীয় সেঞ্চুরি করেছিলেন!

আমরা যারা বিদেশে থাকি তারা জানি দেশের একটু ভালো কিছু, একটু মর্যাদাও আমাদের কাছে কি দারুন হয়ে ধরা দেয়। বিদেশিরা যখন আমাদের দিকে সমীহের দিকে তাকায় তখন আমাদের মনের ভিতর যে কি প্রতিক্রিয়া হয় তা শুধু বিদেশে যারা থাকেন তারাই অনুভব করতে পারেন।

বিদেশে থেকে পদে পদে অনুভব করা যায় মা-মাটির জন্মভূমি দেশটাকে! যা দেশে থেকে সব সময় বোঝা যায় না। দেশের সীমানা পেরুলেই যে কেউ তারা ঢের পান। প্রানের দেশের অর্জন সাফল্য বলতে ভাবতে আমাদের নয়ন জলে ভাসে।

নিউজিল্যান্ডের পাহাড়গুলোকে খুব বেশি উঁচু বলা যাবেনা। এমন টিলা পাহাড় বাংলাদেশের সিলেট-ময়মনসিংহেও অনেক আছে। এসব দেশের নদীগুলো আমাদের দেশের বরিশালের খালের মতো শীর্নকায়! নিউজিল্যান্ডের পাহাড়গুলো অবশ্য আগ্নেয়গিরি, ভূমিকম্পের স্মৃতি জড়িত।

তাসমান সাগর পাড়ের দেশটির দক্ষিন দ্বীপের একটি জনপ্রিয় পর্যটন শহর মাউন্ট মঙ্গানুই। তাওরাঙ্গা শহর থেকে সেখানে যেতে হয়। মঙ্গানুই নাম শুনে মনেই হবে নামকরনটি দেশটির মাওরি আদিবাসী সংশ্লিষ্ট। আসলেই তাই।

এক সময় সক্রিয় আগ্নেয়গিরির অনেকগুলোর স্মৃতি এখনও দেশটির এই পর্যটন স্পট। দেশটার বিভিন্ন এলাকার ছোট ছোট পাহাড় আর জঙ্গলের চূড়া থেকে এখনও আগ্নেয়গিরির স্মৃতি ধোয়া বেরুচ্ছে! এসব স্পটের পুকুর-জলাশয়ে বুদ বুদ চলছে ক্লান্তিহীন!

এগুলোয় পা ডুবিয়ে বসলে হালকা গরম পানির উম অনুভব করা যায়। সেখানে পা ডুবিয়ে বসে থাকলে আপনার ব্যথা-বেদনার গরম জলের থেরাপিও এতে হয়ে যায়! রথ দেখা আর কলা বেচার মতো বিষয় আর কি!

নিউজিল্যান্ডের একটি সমুদ্র সৈকতের নাম হট ওয়াটার বীচ! সৈকতের বালি খুড়ে পা একটু গর্তের ভিতর নিলেই পানি গরম মনে হবে। পাহাড় আর সমুদ্রের নীচেই সক্রিয় আগ্নেয়গিরি। এর সবকিছুর জন্যে নিউজিল্যান্ড একটি ভূমিকম্প প্রবণ দেশ।

ভূমিকম্পের শংকার কারনে নিউজিল্যান্ডে কোন পাতাল পথ নেই। পাতাল রেল বা সড়ক পথ নির্মানের কোন পরিকল্পনাও নেই। ভয় ভুমিকম্পের।

আজকের যুগে আমরা ক্রিকেট আর সর্বশেষ মসজিদে হামলায় মর্মন্তুদ হতাহতের ঘটনার কারনে ক্রাইস্টচার্চ শহরের নাম অনেকেই জানি। তখন বাংলাদেশ দল অবস্থান করছিল ক্রাইস্টচার্চে। জুম্মার নামাজ পড়তে জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা মসজিদে রওয়ানা হয়েছিলেন।

কিন্তু মসজিদে পৌঁছবার আগেই গোলাগুলির শব্দ আর ভীতিকর খবরটি জেনে তারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। সেই নারকীয় ঘটনার পর বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের নিউজিল্যান্ড সফর বাতিল করে খেলোয়াড়দের দেশে ফিরিয়ে নেয়া নয়।

সর্বশেষ বড় একটি ভূমিকম্পে ক্রাইস্টচার্চ শহরটির নানান অংশ বিধ্বস্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিধ্বস্ত শহর পুনঃনির্মানের কাজ পায় সিঙ্গাপুরের একটি নির্মান কোম্পানি। সেই কোম্পানি শহরটি পুনঃনির্মানে তাদের দক্ষ বাংলাদেশি জনশক্তি ক্রাইস্টচার্চে নিয়ে আসে।

আজকের যুগে ক্রাইস্টচার্চে বাংলাদেশি জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য অংশ সেই সুযোগে সিঙ্গাপুর থেকে এসে সেখানে থিতু হয়েছেন। তারাই গত অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড ওয়ানডে বিশ্বকাপের সময় ক্রাইস্টচার্চ থেকে নেলসনের মাঠে বাংলাদেশের খেলা দেখতে গিয়ে গ্যালারিতে লালসবুজ পতাকা উচিয়ে বাংলাদেশ বাংলাদেশ বলে জয়োল্লাস করেছেন।

সেই খেলার বাংলাদেশ স্কটল্যান্ডকে হারায়। তখন নেলসনে কোন বাংলাদেশি না থাকায় ক্রাইস্টচার্চ থেকে যাওয়া বাংলাদেশিরাই ছিলেন দেশের দলকে সমর্থনের ভরসা।

মাউন্ট মঙ্গানুইতে যে স্বল্পসংখ্যক বাংলাদেশিকে দলের জার্সি পরে দেশের পতাকা উঁচিয়ে জানান দিয়েছেন তারাই সেখানে বাংলাদেশ। তারাও তাওরাঙ্গা সহ আশেপাশের বিভিন্ন শহর থেকে খেলা দেখতে সেখানে গেছেন।

নিউজিল্যান্ড দেশটির নিজস্ব জনসংখ্যা ৫১ লাখের কম। এখন মাঠে দেশটির যে সমর্থকদের দেখা যায় ক্রিসমাস-নিউইয়ারের ছুটির কারনে তাদের বড় অংশ মাঠে আসতে পেরেছেন। ক্রিসমাস-নিউইয়ার উপলক্ষে জানুয়ারির ৩ তারিখ পর্যন্ত দেশটায় সরকারি ছুটি ছিল।

এমনিতে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড বা ইউরোপীয় দেশগুলোর টেস্ট ক্রিকেটের দর্শকদের বড় অংশ পেনশনার বুড়ো-বুড়ি। শহরে টেস্ট ক্রিকেটের মতো আয়োজন তাদের সময় কাটানোর সুযোগ নিয়ে আসে। পেনশনার হিসাবে যানবাহনের মতো ক্রিকেট সহ নানান খেলার টিকেটেও তারা বিশেষ ছাড় পান।

এখন ভ্রমন কাহিনী বাদ দিয়ে মঙ্গানুই টেস্টের হিসাব-নিকাশে আসি। নিউজিল্যান্ডের দৈনিক দ্য নিউজিল্যান্ড হ্যারাল্ডের অনলাইন সংস্করনে খেলাটির ভূমিকায় লেখা হয়েছে, ‘এনাদার ডমিনেটিং ডে’ বাই বাংলাদেশ’। এরপর আবার পত্রিকাটি আশা জানিয়ে লিখেছে, এখনও বাংলাদেশকে হারানো সম্ভব!

বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশ দলের হাতে ব্ল্যাক ক্যাপসদের দ্বিতীয় দিনের প্রথম সেশনে অলআউট করাটা ছিল একটি প্রথম ঘটনা। পরিচিত কিছু খেলোয়াড় ছাড়া যেখানে এবারে নিউজিল্যান্ড সফরে যাওয়া দলটি ছিল ভাঙ্গাচোরা একটি দল।

বাংলাদেশের এই দলটিই এরমাঝে নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটবোদ্ধাদের কাছে যথেষ্ট সমীহ অর্জন করেছে। ম্যাকমিলানসহ কিউই ক্রিকেট লিজেন্টরা দলের ব্যর্থতার সমালোচনার পাশাপাশি বাংলাদেশ দলের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছেন, নিউজিল্যান্ডের মাটিতে এটিই বাংলাদেশ দলের সেরা একটি দিন!

মিরাজ-শরিফুল-তাসকিনদের সামনে প্রথম ইনিংসে নিউজিল্যান্ড দল গুটিয়ে যায় ৩২৮ রানে। বাংলাদেশ দ্বিতীয় দিন শেষ করে স্বপ্নের মতো ১৭৫/২ স্কোর নিয়ে! তৃতীয় দিন সকালে মাহমুদুল হাসান জয় ও মুশফিককে হারিয়ে সমস্যায় পড়ে যায়বাংলাদেশ দল।

এটা ছিল মাহমুদুল হাসানের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ম্যাচ। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ম্যাচেই সেঞ্চুরির আশা জাগিয়েছিলেন এই যুবা। কিন্তু তা আর হলোনা। বাংলাদেশ দলের মিস্টার ডিপেন্ডবল বলে পরিচিত মুশফিকুর রহিমও ট্রেন্ট বোল্টের শিকার হয়ে সাজঘরে ফিরলে দিনের প্রথম সেশনটা হতাশা ছড়ায়।

কিন্তু অধিনায়ক মমিনুল হক সৌরভ, লিটন দাশের দৃঢ়তায় দ্বিতীয় সেশনটা বাংলাদেশ নিজের করে নেয়। লিটনের নান্দনিক ব্যাটিং এর সঙ্গে মমিনুলের দৃঢ়তায় দিনটি বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্যে স্বপ্নের মতো মনে হয়! নিউজিল্যান্ডের বিশ্বসেরা বোলাদের পরীক্ষা নিচ্ছিলেন লিটন-মমিনুল।

দলের অন্তত তিনজন ব্যাটসম্যান সেঞ্চুরির আশা জাগিয়েছিলেন! তাদের কেউ সেঞ্চুরি পর্যন্ত পৌঁছতে না পারলেও চারজন ব্যাটসম্যান অর্ধশতক করেছেন, এটিও অনেকদিন পর বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশ টেস্ট দলের জন্যে নতুন একটি ঘটনা!

বাংলাদেশে পাকিস্তানি সংস্কৃতির উত্থানের পর থেকে সৌম্য সরকার, লিটন দাশ এগুলো এখন অনলাইন গালির নাম! এসব গালি হজম করে হলেও সৌম্য-লিটনরা দেশের জন্যে খেলেন। মাউন্ট মঙ্গানুইতে লিটন যতক্ষন ক্রিজে ছিলেন ততক্ষণ এরা উস্খুশ করছিলেন!

লিটন আউট হবার পর অনলাইনে এদের মুখস্ত মন্তব্য ভেসে আসে, ‘কুফা লিটন গেছে’!

প্রথম সেশনে দুই উইকেট, তৃতীয় সেশনে দুটি উইকেট গেলেও দ্বিতীয় সেশনে কোন উইকেট যায়নি। তৃতীয় দিনে বাংলাদেশ ২২৬ রান করেছে! তৃতীয় দিন শেষে বাংলাদেশ লিড নিয়েছে ৭৩ রান। হাতে এখনও মেহেদি হাসান মিরাজ সহ চার উইকেট রয়েছে। তৃতীয় দিন শেষে বাংলাদেশ পেরিয়েছে ৪০০ রানের মাইল ফলক!

এসব নিয়ে মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টের দ্বিতীয় দিনের মতো তৃতীয় দিনটাও দারুন কেটেছে বাংলাদেশের। সেভাবে তৃতীয় দিনেও বাংলাদেশ খারাপ লাগার মতো কিছু করেনি। ১৫৬ ওভারে ৬ উইকেটে ৪০১ রান হাতে নিয়ে দিন শেষ করেছে বাংলাদেশ! বিদেশের মাটিতে এত দীর্ঘ সময় ধরে ক্রিজে টিকে থাকার ঘটনা বাংলাদেশের এই প্রথম।

অতএব মাউন্ট মঙ্গানুইর চূড়ায় বাংলাদেশের পতাকাতো উড়বেই।