প্রিয় প্রজন্ম || Priyo Projonmo

শৈলকুঠিরে জয়নাল হাজারীর চিরশয্যা

ফজলুল বারী

প্রকাশিত: ০১:০৩, ২৯ ডিসেম্বর ২০২১

শৈলকুঠিরে জয়নাল হাজারীর চিরশয্যা

জয়নাল হাজারী মারা গেছেন তিনি এখন সবকিছুর উর্ধে২৭ ডিসেম্বর জয়নাল হাজারীর মৃত্যুর খবর যখন আসে তখন আমি একটি লেখার কাজে ব্যস্ত ছিলাম। আমার ল্যাপটপে তখন টের পাচ্ছিলাম ব্রেকিং নিউজ হিসাবে তাঁর চলে যাবার খবরটি আসছিল।

জয়নাল হাজারী ছিলেন দেশের আলোচিত-বিতর্কিত রাজনীতিবিদদের অন্যতম। তাঁর বয়স হয়েছিল। তিনি অসুস্থ ছিলেন তা আমরা প্রথম জানতে পারি যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে তাঁর ত্রান তহবিল থেকে চিকিৎসার জন্য অর্থ সহায়তা দেন। কিন্তু তখন তাঁর অসুস্থতার কারন জানতামনা।

মূল অসুস্থতা ছিল এক রকম নো-হোয়ার হয়ে যাওয়া! আওয়ামী লীগ টানা বারো বছর ধরে ক্ষমতায়। কিন্তু তাকে কি কোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় কেউ দেখেছে? তিনি প্রায় প্রতিদিন ফেসবুক লাইভে এসে নানান বিষয়ে তাঁর বক্তব্য তুলে ধরতেন।

শুধু মিডিয়াকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। শেখ হাসিনা মিডিয়ার দিকে তাকিয়ে দেশ চালাননা। আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যের মর্যাদায় জয়নাল হাজারী মৃত্যুবরন করেছেন ঠিক, কিন্তু এই অলংকারিক উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের কাজ তেমন নেই।

জয়নাল হাজারীর এক সময়কার নেতা-কর্মীরা তাঁকে তাঁর উৎপত্তিস্থল ফেনীতেও তাঁকে নো-হোয়ার করে দিয়েছিলেন! দলের ঢাকার বার্তা সমর্থন ছাড়া এটা সম্ভব ছিলোনা। তাঁর এক সময়কার দক্ষিন হস্ত রাজনৈতিক কর্মী আরজু এক রকম দুঃস্থ-নিঃস্ব অবস্থায় ফেনীতে মারা যান। তাঁর জানাজায় অনেক লোক হয়ছিল।

জয়নাল হাজারীর মতো একদার দাপুটে একজন রাজনীতিবিদ এমন নো হোয়ার অবস্থায় বেঁচে থাকেন কী করে! জয়নাল হাজারী সমর্থক ফোরাম ফেসবুক পেইজে তাঁর শেষ সময়ের ছবিগুলো আছে। তাঁর মৃত্যুর পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোক প্রকাশের বহর লেগেছে।

মৃত্যু পথযাত্রী এই নেতাকে শেষ দেখা দেখতে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের কোন নেতা হাসপাতালে দেখতে গিয়েছেন এমন কোন ছবি-নিউজও আমার চোখে আসেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে চিকিৎসার জন্যে যে অর্থ সাহায্য দিয়েছিলেন তা কোথাও পঞ্চাশ লক্ষ, কোথাও ষাট লক্ষ উল্লেখ করা হয়েছে।

যে অংকের সহায়তা দেয়া হোক না কেনো এটি তাঁর অর্থনৈতিক সততার ইঙ্গিত করে। কারন জয়নাল হাজারী যে দাপুটে নেতা ছিলেন তিনি চাইলে জীবনে অনেক টাকার মালিক থাকতে পারতেন। আজকের যুগে অনেক ছিঁচকের কাছে থাকা টাকার অংক শুনলেও চমকে যেতে হয়।

কিন্তু জয়নাল হাজারীর বলা চলে একজন দুঃস্থ ব্যক্তি হিসাবে মৃত্যু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ত্রান তহবিলের টাকা নিয়ে তাকে চিকিৎসা করাতে হয়েছে। আবার আওয়ামী লীগের ১৯৯৬ সালের ক্ষমতার সময় দাপুটে এমপি থাকতে বাড়ির কাছে নির্মানাধীন ক্রীড়া কমপ্লেক্স ভেঙ্গে পড়ে ব্যাপক হতাহতের ঘটনায় তাকে দায়ী করে ওবায়দুল কাদের রিপোর্ট দিয়েছিলেন শেখ হাসিনার হাতে।

আমার পত্রিকা জনকন্ঠে জয়নাল হাজারীকে নিয়ে দিনের পর দিন রিপোর্ট হয়েছে। দিনের পর দিন তখন জনকন্ঠ ফেনীতে বিলি-বিক্রি করা যায়নি। পত্রিকার গাড়ি ফেনীতে ঢোকার আগেই এর বান্ডিল নামিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তখন চৌদ্দগ্রাম বা আশেপাশের নানান এলাকা থেকে জনকন্ঠের কপি বা এর ফটোকপি গোপনে বিলি-বিক্রি হতো ফেনীতে।

জনকন্ঠ যে জয়নাল হাজারীর বিরুদ্ধে লিখতো এটাও ছিল রাজনৈতিক। এসব নিয়ে পরে লেখা যাবে। আমি ফেনী পলিটেকনিকে পড়াশুনা করেছি। তাই ফেনীর নানাকিছু আমার সরেজমিন জানাশোনার সুযোগ হয়েছে। তখনও সন্ত্রাস সন্ত্রস্ত জনপদের বাইরে ফেনী ছিল ভিন্ন এক সাংস্কৃতিক শহর।

ট্রাংক রোডের রাস্তার দু’পাশের ঢালের নীচে অনেকগুলো প্রেস থেকে সোনার হরিন, শিলুয়া সহ অনেক চমৎকার সব পত্রিকা বেরুতো। জয়নাল হাজারী এক সময় বাংলার বানী পত্রিকার ফেনী সংবাদদাতাও ছিলেন। এক সময় তাঁর মাষ্টারপাড়ার বাসা’র বাইরে তেমন একটা সাইনবোর্ডও ছিল।

ফেনী শহর আর শহরতলী তখন জয়নাল হাজারী আর জাসদ-রবের ভিপি জয়নালের নেতৃত্বে ভাগাভাগি করে রাখা ছিলএক সময় লেবাননের গৃহযুদ্ধ থামাতে দেশটির রাজধানী বৈরুত শহর খ্রিস্টান-মুসলিম-শিয়া-সুন্নি এমন নানান ভাগে ভাগ করা। ফেনী শহরও তখন এক রকম ভাগ করা ছিল।

ফেনী পলিটেকনিক, হাসপাতাল, একাডেমী এলাকা ছিল জাসদ-রবের ভিপি জয়নাল সমর্থকদের দখলে। ফেনী শহর, মাষ্টার পাড়া এসব জয়নাল হাজারীর সমর্থকরা নিয়ন্ত্রন করতেন। ছাত্রলীগের ছেলেরা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে পলিটেকনিকে ক্লাস করতে পারলেও ছাত্রাবাসে তারা নিষিদ্ধ ছিলেন। দুই জয়নালের দাপটের দ্বন্দ্বে বছরের বড় সময় বন্ধ থাকতো পলিটেকনিক।

জনকন্ঠে যোগ দেবার আগে ফেনীর মাষ্টার পাড়ার বাড়িতে একবার জয়নাল হাজারীর সাক্ষাৎকার নিয়ে ছিলাম। সাক্ষাৎকারটি অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক সন্দ্বীপে ছাপা হয়। সেই বাড়িতে সেদিন বিদ্যুৎ ছিলোনা। বাড়িটা দূর্গের মতো লাগছিল।

আমাকে জয়নাল হাজারী বলছিলেন, তাকে অনেকে সন্ত্রাসের গডফাদার বলেন কিন্তু তার কান্নার খবর খুব কম লোক জানে। তাঁরও জ্যোৎস্না রাতে বাগানে বসে চাঁদ দেখতে ইচ্ছা করে। ভালো লাগে। তাকে যখন কোন কারনে গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে থাকতে হয়, পরিচর্যার অভাবে তাঁর পোষা পাখি যখন মরে যায় তখন তার খুব কান্না পায়

জয়নাল হাজারী বলেন তার জীবন অনেক কষ্টের। যখন তখন পুলিশি হয়রানির কারনে তাঁর বাসায় কোন কাজের লোক থাকতে চায় না। আমি তখনও বিজু’র গল্প বা বিজু কাহিনী এসব জানতামনা। এখন ইন্টারনেটের যুগে জানার কতকিছু সহজ হয়ে গেছে।

জয়নাল হাজারীর সঙ্গে আমার শেষ কথা হতো তাঁর বাড়িতে যৌথ বাহিনীর অভিযানের পর। রিপোর্টের কাজে তখন প্রতিদিন তাকে আমি ফোন করতাম। অথবা তিনি আমাকে ফোন করতেন। তখনও তিনি ফেনীর সীমান্তের ওপারের এমন কোথাও ছিলেন যেখানে বাংলাদেশের গ্রামীন ফোনের নেটওয়ার্ক কাজ করতো।

তখনও আমাকে বলার চেষ্টা করতেন তিনি বাংলাদেশের ভিতরেই আছেন। এখনতো তিনি সত্যি সত্যি পৃথিবীর সব নেটওয়ার্কের বাইরে। চিরদিনের তরে। ফেনীতে তখন জেলা প্রশাসক ছিলেন পরবর্তীতে জামায়াত ও আজকের এবি পার্টির নেতা সোলায়মান চৌধুরী।

তখনই সেই জেলা প্রশাসককে একজন রাজনৈতিক দলের নেতার মতো মনে হতো। চেইন স্মোকার ছিলেন জেলা প্রশাসক সোলায়মান চৌধুরী। একটার পর একটি সিগারেট ধরিয়ে তিনি বলছিলেন, হাজারীর এই ভেঙ্গে দিয়েছি সেই ভেঙ্গে দিয়েছি।

একবার আমরা তৎকালীন বিরোধীদলের নেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ট্রেনে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলাম। পথে বিভিন্ন রেল স্টেশনে সমাবেশে বক্তৃতা করে করে যাচ্ছিলেন শেখ হাসিনা। ফেনীতে ট্রেন গিয়ে পৌঁছে রাত দু’টোর পর। সেই রাতে জয়নাল হাজারীর ক্লাস কমিটির সদস্যরা শেখ হাসিনাকে স্মরনীয় গার্ড অব অনার দেন।

মৃত্যুটাকেও তিনি তাঁর মতো করে সাজিয়েছেন! ফেসবুক লাইভে বলে গেছেন জানাজা যেন ফেনীর পাইলট স্কুলের মাঠে হয়। তাঁর কবর যেন হয় মাষ্টারপাড়ার শৈল কুঠিরের মুজিব উদ্যানে। আমার ধারনা তাঁর কবরটা দিনে দিনে মাজার হয়ে উঠতে পারে।

তাঁর মৃত্যুর পর অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজু কাহিনী ব্যাপক ছড়িয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে দেশ স্বাধীন করে এসে তিনি দেখেন প্রেমিকা বিজু অন্যজনের ঘরনী। হাজারীর মনে হয়েছে বিয়েটা বিজু’র ইচ্ছার বিরুদ্ধে হয়নি। এই রাগে-অভিমানে তিনি আর বিয়ে না করে চিরকুমার থেকে যান।

স্কুল মাষ্টার হিসাবে বিজু পরবর্তীতে অবসরে যান। এরমাঝে বিজু’র স্বামীও মারা গেছেন। তাঁর ছেলে থাকেন কানাডায়। একবার স্কুলের কোন একটি সমস্যায় বিজু জয়নাল হাজারীকে ফোন করেছিলেন। বিব্রত হাজারী তাঁর সঙ্গে কথা না বলে ফোন কেটে দেন।

বিজু কী জয়নাল হাজারীকে শেষ দেখা দেখতে এসেছিলেন? প্রকাশ্যে না হলেও দূর থেকে? অথবা জয়নাল হাজারীর কবর জিয়ারতে আসবেন? প্রেমিক জয়নাল হাজারী ও তাঁর বিজুকে নিয়ে গল্পগুলোও চলতে থাকবে। সাবেক রাজনীতিবিদ জয়নাল হাজারীর পক্ষ-বিপক্ষ ছিল-থাকবে। প্রেমিক জয়নাল হাজারীর কোন বিপক্ষ নেই।