প্রিয় প্রজন্ম || Priyo Projonmo

দশ ডিসেম্বরের পর থেকে দেশ চলবে খালেদা জিয়ার কথায়

ফজলুল বারী

প্রকাশিত: ১৫:৫৭, ৯ অক্টোবর ২০২২

দশ ডিসেম্বরের পর থেকে দেশ চলবে খালেদা জিয়ার কথায়

খালেদা জিয়া অসুস্থ। দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। গোপালি শেখ হাসিনার নাম তিনি শুনতে পারেননা। ক্ষমতায় থাকতে শেখ হাসিনাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন। এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দয়া নির্ভর তার জীবন! ছয় মাস পরপর শেখ হাসিনা তার গুলশানের বাসায় থাকার আবেদন মঞ্জুর করেন।

বিএনপি বিভিন্ন সময়ে খালেদা জিয়ার মৃত্যুর আশংকা জানিয়ে তাকে বিদেশে নিয়ে যাবার দাবিতে আন্দোলন করে অসফল হয়েছে। কারন দেশের লাখ লাখ মানুষ দেশেই যথাযথ চিকিৎসা পান না। রাজনীতিকসহ প্রভাবশালীদের বিদেশে চিকিৎসার প্রবনতাকে তারা ঘৃনা করেন।

খালেদা জিয়া চরম রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হওয়া স্বত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে বিশেষ কিছু সুযোগ সুবিধা দিয়েছেন। জেলখানায় তার সঙ্গে থাকতে দিয়েছেন গৃহকর্মী ফাতেমাকে! এখন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে বিশেষ ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত রেখে তাকে গুলশানের বাসায় থাকার সুযোগ দেয়া হয়েছে।

খালেদা জিয়ার পরিবার এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ৬ মাস পরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন করে করে বিএনপি নেত্রীর বাসায় থাকার সুযোগ রক্ষা করে যাচ্ছেন। বাসায় থেকে দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল হাসপাতাল এভারকেয়ারে চিকিৎসা নিচ্ছেন বিএনপি নেত্রী।

আর বিএনপি রাস্তার সমাবেশে বলেই চলেছে তারা খালেদা জিয়াকে আন্দোলনের মাধ্যমে মুক্ত করে ছাড়বে! বিএনপি নেতা আমান উল্লাহ আমান এককাঠি সরেস বলেছেন আগামী ১০ ডিসেম্বর থেকে দেশ চলবে খালেদা জিয়ার কথায়! শেখ হাসিনার কথায় নয়! দেশ শাসনতো বহুদূর। খালেদা জিয়া এখন জেলখানার বাইরে আছেন শেখ হাসিনার কারনে।

আমান উল্লাহ আমান অবশ্য বিএনপির বোঝা এক নেতার নাম। আমানের উত্থান পর্বটি এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের নেতাকর্মী-সাংবাদিকদের চোখে দেখা। সাদা পাজামা পাঞ্জাবি যেটা পড়তেন সেটাও দামি ছিল না। ময়লা থাকতো। সেই সময়ের সিংহভাগ ছাত্রনেতাদের জীবন তখন এমন সাদামাটা ছিল।

মনটা সবার তখন অনেক বড়। আর সাহসী। যুথবদ্ধ শপথ ছিল স্বৈরাচার এরশাদ পতনের। সেই শপথে ঘুন ধরলো লোভ ধরলো এরশাদের পতনের পর। আমানকে ডাকসু ভিপি পদে মনোনয়ন দেয়া হয়। কিন্তু ছাত্রদলের নিরু-অভি গ্রুপ এতে রাজি নয়। নিরু তখন ছাত্রদলে ভীষন জনপ্রিয়।

শ্লোগান দেয়া হতো-নিরু তবু ভিরু নয়। মধুর কেন্টিনের সামনের মাটিতে আমানকে বসিয়ে ঘিরে রাখে নিরু-অভি গ্রুপ। আমানকে ঘোষনা দিতে হবে তিনি ভিপি পদে নির্বাচন করবেননা। চাপের মুখে আমান সেখানে হাউমাউ করে কাঁদেন। যাকে সামনে পান তারই পা ধরেন।

কারন আমান জানেন সন্ত্রাসী নিরু-অভি গ্রুপের ক্যাডাররা সেখানে তাকে মেরেই ফেলতে পারে। এখনতো ছাত্রদলের সবাই সাধু চাচা! কিন্তু তারা এদেরই উত্তরসূরী। আমান সেখানে নতজানু হননি। সেটাই তার উত্থান। ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন আমান। এরশাদের পতন হয়।

ব্যবসায়ীরা কালো টাকায় কিনে নেয় আমান সহ এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের বেশিরভাগ ছাত্রনেতাদের। আমান-খোকন ডাকসুর ভিপি-জিএস ছিলেন। খুব স্বাভাবিক তাদের মাথার দামও ছিল বেশি।

এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের ছাত্র ঐক্যের শপথ ছিল স্বৈরাচার এরশাদের কোন দোসর-দালালকে আওয়ামী লীগ-বিএনপি সহ রাজনৈতিক দলগুলোয় আশ্রয় দেয়া হবেনা। এই শপথও প্রথম ভঙ্গ করে আমান-খোকনদের দল বিএনপি। তাদের নেত্রী খালেদা জিয়া।

এরশাদের আমলা দোসর এম কে আনোয়ার-কেরামত আলী আওয়ামী লীগে যোগ দিতে ধানমন্ডির ৩২ নাম্বার বাড়িতে গেলে শেখ হাসিনা তাদেরকে দেখা দেননি। সেখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে ধানমন্ডির ২৭ নাম্বার সড়কে তৎকালীন বিএনপি অফিসে গিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে তারা বিএনপিতে যোগ দেন।

এরা পরে বিএনপির দাপুটে মন্ত্রীও ছিলেননা।আমান উল্লাহ আমানও বিএনপির মনোনয়ন পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন। দিনে দিনে আমান হয়ে ওঠেন বিএনপির অন্যতম শীর্ষ দুর্নীতিবাজ নেতা! একবার বিএনপি-জামায়াতের পত্রিকা মানবজমিনেও আমানের দুর্নীতির ফিরিস্তি ছাপা হয়।

সেই রিপোর্টে দেখানো হয় স্বল্পতম সময়ের মধ্যে বাংলার কামান আমান উল্লাহ আমান ঢাকায় ও ঢাকার আশেপাশে কতগুলো ফ্ল্যাট সহ বিপুল জমি-সম্পদের মালিক বনে গেছেন! বিএনপি আমলে আমান বাহিনীর দূর্ব্যবহারের প্রতিবাদে সচিবালয়ে বিদ্রোহ ঘটে।

এর প্রতিবাদে সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে যার যার অফিস থেকে বেরিয়ে রাজপথের আন্দোলনে যোগ দেন। বিএনপি সরকারের পতন হবার পর তারা অফিসে ফিরেছেন। এরপর জনরোষের ভয়ে আত্মগোপনে ছিলেন আমান। বিএনপিতেও অনেক দিন কোনঠাসা ছিলেন।

সেই আমান এখন বড়গলায় বক্তৃতা দেন। কারন বিএনপির নতুন প্রজন্ম তাকে চেনেনা জানেনা। তারা তাকে ডাকসুর সাবেক ভিপি হিসাবেই তাকে জানে। কিন্তু ডাকসুর সাবেক ভিপি পরে কী রকম ফুলের মত পবিত্র(!) হয়েছিলেন তা তারা জানেনা। এই প্রজন্মের সাংবাদিকরাও জানেনা ডাকসুর ভিপির আগেপরের চেহারা ।

সেই আমান উল্লাহ আমানের ঘোষনা ১০ ডিসেম্বরের পর দেশ খালেদা জিয়ার কথায় চলবে, সেটা আরেকটা ‘ঈদের পরের আন্দোলনের’ মতই হবে। কারন দেশের মানুষের সেই সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নেই। খালেদা জিয়ার নেই আগের সেই দ্যুতি।

ভুরু চিকন করে আঁকলেও এই খালেদার জীবন হুইল চেয়ার নির্ভর। হাত বেঁকে গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন করে গৃহকর্মী ফাতেমাকে জেলখানায় সঙ্গে নিয়ে তিনি দায়বদ্ধ হন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন গণভবনের সংবাদ সম্মেলনে মজা করে বলেছিলেন, খালেদা জিয়া চাইলে তিনি তাকে জেলখানায় একজন মেকআপম্যানও দেবেন।

এখন শেখ হাসিনার কাছে আবেদন করেই তিনি কারাগারের বদলে গুলশানের বাসার শর্তসাপেক্ষে বসবাস করতে পারছেন। অতএব খালেদা জিয়ার জীবনটাই এখন শেখ হাসিনার দয়া নির্ভর। এমন যারা থাকেন তারা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে পারেননা।

বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী-সমর্থকদের ওপর কি মাপের নির্যাতন করেছে তা দেশের সবাই কিন্তু ভুলে যায়নি। তারেক রহমান ফতোয়া উচ্চারন করে বলতেন, ‘কখনও কখনও শক্তি প্রয়োগও ন্যায় সঙ্গত! এটা ধর্মেই আছে!’ এসব জুলুম মোকাবেলা করেই আওয়ামী লীগ দলটি আজ ক্ষমতায়।

আর বিএনপি ‘সারাক্ষন কে মেরেছে কে বকেছে’ জাতীয় কান্না করার দল। এই দলের হাইকমান্ডই অকার্যকর। হাইকমান্ড ওয়ান খালেদা জিয়া রোগ-ব্যাধি আর বার্ধক্যজনিত কারনে এখন শেষবেলার অপেক্ষায়। তার ছেলে গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের পার্টনার ছিলেন। সেই পার্টনার এখন জেলখানায়।

বিএনপি প্রতিদিন এত কথা বলে, কিন্তু তাদের নেতার পার্টনারের জেল-জীবন নিয়ে কখনও কথা বলেনা! নেতার রিক্রুট তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের জেল জীবন নিয়েও বলেনা কিছু! তাদের নেতা আরেক দেশের কাছে নাগরিকত্ব-পাসপোর্ট সপে দিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন।

তার মাথার ওপর একাধিক দন্ডের সাজা। এসব নিয়ে দেশের আইনে তিনি পলাতক। পলাতক ব্যক্তি হিসাবে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে দেশের কোন মিডিয়ায় তার বক্তব্য প্রচার হয়না। বিএনপির এত আইনজীবী নেতা! টেলিভিশনে সুন্দর সুন্দর কথা বলেন।

কিন্তু তাদের নেতা পলাতক আসামী তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কখনও কোথাও টু শব্দটি করেননা! খালেদা জিয়ার চিকিৎসা জামিনের জন্যে বিএনপির আইনজীবীরা সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের দরজায় লাথি মেরেও সাফল্য পাননি।

খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা, ‘যে কোন মূহুর্তে কিছু ঘটে গেলে সরকার দায়ী থাকবে’ এমন বক্তব্য বিএনপি নেতারা বহুদিন বলেন না। এই কিছুদিন আগেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন করে খালেদা জিয়ার গুলশানের বাড়িতে থাকার মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়ানো হয়েছে।

তাই এই দলের নেতারা যখন বলেন অমুক তারিখের পর দেশ চলবে খালেদা জিয়ার কথায়, শেখ হাসিনার কথায় নয়, দেশের মানুষ হাসে, প্রিয় প্রজন্ম বাহিনী যারা অনেক কাচ্চি পার্টি করেছে তারাও ট্রল করে। ট্রলে দুদু মিয়া নেতা শামসুজ্জামান দুদু’র নামও যুক্ত করা হয়েছে।

ভারতে বিজেপি প্রথম ক্ষমতায় আসা’র পর খুশিতে দুদু মিয়া আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে চলে যেতে বলেছিলেন। গত নির্বাচনের আগে বলেছিলেন, ‘৭ নভেম্বরের পর দেশ চালাবে ঐক্যফ্রন্ট!’ দুদু মিয়া আর বাংলার কামান আমান উল্লাহ আমানরা এভাবে ‘ভাটির দেশে বইসা’ তারিখ ঘোষনা করতেই থাকবে।