প্রিয় প্রজন্ম || Priyo Projonmo

আওয়ামী লীগ ছাড়ল আরেক খন্ড জাসদ

ফজলুল বারী

প্রকাশিত: ২২:২৮, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২

আপডেট: ২৩:১৭, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২

আওয়ামী লীগ ছাড়ল আরেক খন্ড জাসদ

মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশে জাসদ সংঠনটি আলোড়ন সৃষ্টি করে। তরুন মুক্তিযোদ্ধা নেতৃত্ব। ক্ষমতায় না গিয়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখায় যুদ্ধ ফেরত মুক্তিযোদ্ধা আর তরুন প্রজন্মকে। দেশে তখন দৃশ্যমান এন্টি আওয়ামী লীগ দল নেই। নানা রঙের এন্টি আওয়ামী লীগাররাও এখানে এসে যোগ দেন।

যদিও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র দর্শনটা আসলে কী, কী করলে সমাজতন্ত্র বৈজ্ঞানিক অথবা অবৈজ্ঞানিক হয়, তা নেতারা স্পষ্ট করেননি। বা এ বিষয়ে তারাও স্পষ্ট ছিলেননা। শ্লোগান মানুষকে টেনেছে। দুনিয়ার মজদুর এক হও। লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই। প্রতিরোধে প্রতিশোধ, জাসদ জাসদ।

মাথার ওপরে স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম নিউক্লিয়ার্স সাবেক ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান। দাদা ভাই। তার কোন পদ নেই। কিন্তু সিনিয়ররা জানতেন দাদা ভাই’ই নেতা। জরুরি অবস্থা জারির পর জাসদের অনেক নেতাকর্মী গ্রেফতার হন। গ্রেফতার এড়াতে অনেক আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান।

কিন্তু সবাই অবাক হয়ে দেখেন দাদা ভাই গ্রেফতার হননা। তিনি বহাল তবিয়তে বাড়িতেই বসবাস করতে পারেন! আজ পর্যন্ত এ প্রশ্নের উত্তর নেই। পচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে দলটি হতভম্ব অথবা খুশিই হয়। হত্যাকান্ডে হতভম্ব। রাজনৈতিক পালাবদলে খুশি। অনেকটা যেন পিতার সঙ্গে ত্যাজ্য সন্তানদের দ্বন্দ্ব!

বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া জাসদ নেতারা রাজনৈতিক পরিবর্তন চেয়েছেন। হত্যাকান্ড চাননি। যদিও আওয়ামী লীগের অনেক নেতার একটি প্রচলিত ক্ষোভ, জাসদই বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পটভূমি তৈরি করেছে। এই অভিযোগ আংশিক সত্য হতে পারে। পুরো সত্য নয়।

ছাত্রলীগের দুই খন্ডের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে প্রধান অতিথি করা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু কেনো একাংশের সম্মেলনে গেলেন বা তাকে নিয়ে যাওয়া হলো, এর উত্তর নেই। বঙ্গবন্ধু যদি সেদিন কোন অংশের সম্মেলনে না যেতেন, তাহলে কী ছাত্রলীগ ঐক্যবদ্ধ থাকতো, ছাত্রলীগের সেই ভাঙ্গন না হলে কী জাসদ হতো, এসব প্রশ্ন তোলা এখন অবান্তর।

আর জাসদতো আওয়ামী লীগের ভিতরে ঢুকে মুক্তিযুদ্ধের নেতা তাজউদ্দিন আহমদকে অপাক্তেয় করেনি। দাউদকান্দিতে ভোটে জয়ী হন আব্দুর রশীদ ইঞ্জিনীয়ার। তাকে হারাতে ব্যালট বাক্স হেলিকপ্টারে ঢাকায় এনে খন্দকার মোশতাককে জয়ী ঘোষনা করা হয়। এসব জাসদতো করেনি।

জাসদের লক্ষ্য ছিল ভোটে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতায় যাবে। কিন্তু জাসদ দেখলো বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে আওয়ামী লীগের খন্দকার মোশতাক ক্ষমতায়। মন্ত্রী যারা হয়েছেন, তারা সবাই আওয়ামী লীগের লোক। এসব দেখে জাসদের মন খারাপ হয়। জাসদের নেতারা সুযোগ খুঁজতে থাকেন।

এরপর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বিশ্বাস করে চূড়ান্ত সর্বনাশ হয় জাসদের। জাসদের প্ল্যান ছিল ৭ নভেম্বর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে তারা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নিয়ে আসবে। সেখানে জিয়াউর রহমান দেবেন সৈনিক জনতা জাসদের কর্মসূচি বাস্তবায়নের ঘোষনা!

একটা নেতৃত্ব কত রোমান্টিক-অপক্ক-অপরিনত হলে এভাবে বিপ্লবের চিন্তা করতে পারে! অথবা সেই সময়ে সেই বয়সে জাসদ নেতাদের পক্ষে হয়তো এভাবেই ভাবা সম্ভব ছিল। কিন্তু ততোক্ষনে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ আর নারায়ে তকবিরওয়ালারা জিয়াউর রহমানকে ঘিরে ফেলেছে!

উচ্চাভিলাসী জেনারেল জিয়াউর রহমানও বুঝিয়ে দেন তিনি ক্ষমতায় এসেছেন নিজের জন্যে। জাসদের কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্যে নয়। পাকিস্তানের করাচিতে বড় হওয়া জিয়াউর রহমান জাসদ দমন দিয়ে শুরু করেন তার শাসনদন্ডের বিসমিল্লাহ!

উর্দু-ইংরেজি ভাষাতে স্বতঃস্ফূর্ত জিয়াউর রহমান বলতেন বেসমিল্লাহির রাহমিনির রহিম। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতেই জাসদ নেতাদের অনেকে গ্রেফতার হয়েছিলেন। বাকিরা গ্রেফতার হন জিয়াউর রহমানের হাতে। কর্নেল তাহেরের ফাঁসি হয়।

জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আপোস করে অনেক জাসদ নেতা বেরিয়ে আসেন। আ স ম আব্দুর রব চিকিৎসার জন্যে জার্মানি যান। জাসদের পথ ভুল কিনা এ প্রশ্ন দেখা দেয় দলের মধ্যে। জাসদ ভেঙ্গে বাসদ হয়। বাসদও হয় দুইভাগ। একদিকে খালেকুজ্জামান, আব্দুল্লাহ সরকার, শুভ্রাংশু চক্রবর্তী প্রমুখ।

আ ফ ম মাহবুবুল হক, মাইনুদ্দিন খান বাদল, মাহমুদুর রহমান মান্না প্রমুখ আরেক বাসদে। মেজর জলিলের লম্বা চুল-দাঁড়ি ছিল। এরসঙ্গে মাথায় একটি টুপি যুক্ত করে ইসলামী আন্দোলনের নেতা হয়ে যান জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মেজর জলিল। তার উল্টো রথযাত্রায় জাসদের ভিতরে-বাইরে ঝড় ওঠে।

দলটি হাসি-ঠাট্টার সংগঠনে পরিনত হয়। অনেকে রাজনীতি থেকেই নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। এরপর জাসদ শুধুই ভেঙ্গেছে। অথবা চলমান থাকে দলত্যাগ। দল ভাঙ্গাভাঙ্গির হতাশার দ্বন্দ্বে অথবা লোভে কেউ বিএনপি কেউ জাতীয় পার্টিতে যান। গয়েশ্বর রায়, আব্দুস সালাম এরা জাসদ নেতা ছিলেন।

নিজের খন্ড জাসদ নিয়ে বিএনপিতে বিলীন হয়েছিলেন শাহজাহান সিরাজ। কি সব চরিত্রের কি পরিনতি! আ স ম আব্দুর রব ডাক্সু ভিপি হিসাবে প্রথম স্বাধীনতার পতাকা তোলেন। বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক ঘোষনা করেন রব। শাহজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পড়েছিলেন প্রথম।

মাদারীপুরের জাসদ ও শ্রমিক নেতা শাহজাহান খানগং আওয়ামী লীগে আসেন। ইনি একবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে বিএনপিতে চলে যাচ্ছিলেন। পরে মনোনয়ন দিয়ে তার বিএনপি যাত্রা ঠেকানো হয়। জাসদের প্রোডাক্ট কতটা ডিগবাজি বিশারদ হতে পারে তা দেখাতে মানুষ মেজর জলিল, আ স ম আব্দুর রব, জিয়াউদ্দিন বাবলু এদেরকে দেখায়।

সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ আমলে দেশের মানুষ দেখেন জাসদের স্থানীয় পর্যায়ের অনেক নেতা এরশাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান-জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হয়ে গেছেন! জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সাধারন সম্পাদক আ স ম আব্দুর রব হয়ে যান এরশাদের গৃহপালিত বিরোধীদলের নেতা!

এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সূচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠনে জাসদ ছাত্রলীগ-বাসদ ছাত্রলীগ-সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। জাসদ ছাত্রলীগের মুনির উদ্দিন আহমদ, আবুল হাসিব খান, শিরীন আখতার, মুশতাক হোসেন, নাজমুল হক প্রধান, শফি আহমেদ সহ আরও অনেকে ছিলেন তখনকার নেতৃত্বে।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন পনের দলের তিন দল ছিল জাসদ(আরেফ-ইনু) এবং দুই বাসদ। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এরশাদের অধীনে নির্বাচনে গেলে পনের দল ভেঙ্গে যায়। ওয়ার্কার্স পার্টি, আরেফ-ইনু’র জাসদ, দুই বাসদ, নির্মল সেনের শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল মিলে গঠিত হয় পাঁচদলীয় জোট।

এরশাদের পতনের পর তার দলের নেতাকর্মীদের মতো তার গৃহপালিত বিরোধীদলের নেতা আ স ম আব্দুর রবও পালিয়ে গিয়েছিলেন। এমন ঘটনা বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরল। গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাসীন সরকারের পতন হলে বিরোধীদলের নেতাও পলায়ন করেন!

এরশাদের পতনের পর বিএনপি সরকার গঠন করলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের অংশী হয় জাসদ সহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কিছু দল। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময়কার আরেফ-ইনু জাসদেও মতদ্বৈততা ছিল। কাজী আরেফকে বলা হতো, মনে করা হতো আওয়ামী লীগপন্থী!

কাজী আরেফ কুষ্টিয়ায় গুলিতে নিহত হলে তার দলের ভিতরে সন্দেহের আঙ্গুল ওঠে। কাজী আরেফ নিহত হবার পর তার স্ত্রী ও জাসদ নেত্রী রওশন জাহান সাথী আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে মহিলা সংসদ সদস্য হয়েছেন। হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাসদ এখন আওয়ামী লীগপন্থী জাসদ হিসাবে চিহ্নিত।

এই জাসদের হাসানুল হক ইনু সরকারের তথ্যমন্ত্রীও হয়েছিলেন। সংসদ সদস্য হয়েছেন নাজমুল হক প্রধান। এই জাসদ থেকে বেরিয়ে গিয়ে শরীফ নুরুল আম্বিয়া-নাজমুল হক প্রধানের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে বাংলাদেশ জাসদ। শুরুতে শিরীন আখতারকে জাসদের সাধারন সম্পাদক করা নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল।

এরপর আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভায় থাকা না থাকা নিয়ে দ্বন্দ্ব। ইনু জাসদ, আম্বিয়া জাসদ কিছুদিন গাদাগাদি করে চৌদ্দদলের প্রেস ব্রিফিঙেও বসেছে। অতঃপর আওয়ামী লীগ ভালোনা বলে চৌদ্দ দল থেকে সরে দাঁড়িয়েছে আম্বিয়া জাসদ। বাংলাদেশ জাসদ।

অতএব তিন খন্ড জাসদের দুটি খন্ড এখন এন্টি আওয়ামী লীগ। রব জাসদ তথা জেএসডি আর বাংলাদেশ জাসদ। শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় নৌপরিবহন মন্ত্রী হয়ে বাদ পড়া এরশাদের গৃহপালিত বিরোধীদলের নেতা আ স ম আব্দুর রবের অপেক্ষা যদি আগামীতে কোনদিন বিএনপি ক্ষমতায় যায় তখন মন্ত্রী হওয়ার।

বাংলাদেশ জাসদের সিপিবি, বাসদ-খালেকুজ্জামান, পঙ্কজ-ন্যাপ, গনফোরাম-মন্টুদের নিয়ে জোট করার আশা। তিন খন্ড জাসদই এখন স্বতন্ত্র সাহসহীন সোনালী অতীত সংঘ। জাসদ ছিল একটি সময়ের বিপ্লবের নাম। টাইম মেশিনে সেই সময়ে আর ফিরে যাবার নয়।

জাসদও তাই আর এখন কোন মূলধারা নয়। অথচ জাসদের ডাঃ মিলনের আত্মাহুতির ঘটনায় দেশে এরশাদের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের সূচনা করেছিল। এত নেতা-কর্মীর আত্মত্যাগ আর রক্তের মচ্ছবের পরও বাংলাদেশের আর কোন দল কী এমন দিকহারা হয়েছে?