প্রিয় প্রজন্ম || Priyo Projonmo

"দেশের স্বার্থে"

ইঞ্জিনিয়ার আব্দুর রাজ্জাক

প্রকাশিত: ২২:৩৫, ৪ জুলাই ২০২১

https://www.facebook.com/razzak.abdur.359

আমি একসময় পিএসআই কোম্পানিতে চাকরি করতাম, আমি ওই কোম্পানির ডাইরেক্টর অপারেশন ছিলাম। মোদ্দা কথা বলতে গেলে অপারেশনাল এবং ফাংশনাল সবকিছুই আমাকে দেখভাল করতে হতো। ২০০০ সালের ১৫ ই ফেব্রুয়ারি থেকে বাংলাদেশ সরকার আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক এই ব্যবস্থা চালু করে। আমি যে কোম্পানিতে চাকরি করতাম সেই কোম্পানির আওতাভুক্ত ছিল ইন্ডিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কোরিয়া সহ অন্যান্য কিছু দেশ।এক কথায় বলতে গেলে এইসব দেশ থেকে যেসব পণ্য বাণিজ্যিকভাবে আমদানি হবে , সব কিছুরই ভ্যালুয়েশন সার্টিফিকেট আমাদের কোম্পানির কাছ থেকে নিতে হতো। এই সার্টিফিকেটকে বলা হত ক্লিন রিপোর্টস অফ ফাইন্টিংস। সংগত কারণেই ইন্ডিয়া থেকে আমাদের দেশে অনেক পণ্য আমদানি হয়, তাই ইন্ডিয়ান হাইকমিশনের সাথে প্রায়ই আমার মিটিং করতে হতো। বিশেষ করে ইন্ডিয়ান হাই কমিশনের, কমার্শিয়াল কাউন্সেলর মিস্টার হামিদ আলী রাও এর সাথে প্রায়ই মিটিং করতে হতো। হামিদ আলী রাও ছিলেন লখনৌ এর মানুষ। উচ্চতা ৬ ফুট গায়ের রং ফর্সা যদি কেউ অমিতাভ বচ্চন ভেবে তাকে ভুল করে তাহলে কাউকে দোষ দেওয়া যাবে না। সুন্দর ইংলিশ বলেন বাংলাদেশ থাকার পরে আমাদের সমাজ ব্যবস্থার খানিকটা রপ্ত করে নিয়েছিল।

হামিদ আলী রাও সব সময় মনিটরিং করতেন ইন্ডিয়া থেকে বাংলাদেশে কোন কোন পণ্য আমদানি হয়, কোন পথ থেকে, কোন ধরনের পণ্য আমদানি হয়। সেই পণ্য অন্য দেশ থেকে, অন্য কোন আমদানিকারক আমদানি করে কিনা?। ইন্ডিয়ায় যেসব পণ্য পাওয়া যায়, সেসব পণ্য অন্য দেশ থেকে আমদানি করার কারণ কি?। এইসব তথ্য তার প্রায় মুখস্থ থাকতো। আমার মনে আছে প্রতিদিন আমরা দেড়শ থেকে দুইশ কন্সাইনমেন্টের সার্টিফিকেট ইস্যু করতাম ইন্ডিয়ান পণ্যের উপরে। কিন্তু হামিদ আলী রাও তাতেও সন্তুষ্ট ছিলেন না।মোট বাণিজ্যিক আমদানি পণ্যের প্রায় ৩০ ভাগ ইন্ডিয়া থেকে আমদানি হত, হামিদ আলী রাও তাতেও খুশি না।

কিছুদিন ঘনিষ্ঠ হওয়ার পরে আমাকে একদিন খোলামেলা বলল, তোমাদের দেশে চাইনিজ পণ্য এত বেশি আসে কেন?। আমরা তো এইসব কাঁচামাল বা বাণিজ্যিক পণ্য চায়নার চেয়েও সস্তায় দিতে পারি। হামিদ আলি রাও এর কাছে খবর ছিল ইন্ডিয়ান পণ্য ছাড় করণে কিছু ঝামেলা হয়।হয়তো আমাদের ক্লিন রিপোর্ট অফ ফাইন্ডিংস ইস্যু করার দরুন কিছু সমস্যা হতে পারে।তাই আমাকে কাছে ধরে রাখার জন্য প্রায়ই ইন্ডিয়ান অ্যাম্বাসিতে দাওয়াত দিয়ে খাওয়াতেন,ও আমদানির প্রতিবন্ধকতার সব কথা খোলামেলা আলোচনা করতেন।

ইন্ডিয়া থেকে বাংলাদেশে সেই সময় যেসব স্থল বন্দর থেকে পণ্য আমদানি হত সেগুলোর মধ্যে ছিল, বেনাপোল, ভোমরা, দর্শনা, বুড়িমারী, সোনামসজিদ, হিলি, আখাউড়া, বিবিড়বাজার, তামাবিল, বড়ছড়া, সুতারকান্দি, খুলনার রুসভেল্ট টার্মিনাল,ইত্যাদি। আমি সাধারণত বেনাপোল চট্টগ্রাম ও মংলা অফিস ভিজিট করতাম মাসে একবার কাস্টমসের সাথেও মিটিং করতাম।

রাও সাহেব একদিন আমাকে বুঝিয়ে কনভিন্স করে বললেন, আমি যেন প্রত্যেকটা স্থলবন্দর পয়েন্টে নিজে গিয়ে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে, যে সামান্য বাধা আছে তা দূর করি, প্রয়োজনে ইন্ডিয়ান এম্বাসী থেকে আমাকে সাহায্য করা হবে।

কিন্তু এইসব আমার সাধ্যের মধ্যে ততটা ছিল না, আমি শুধু আমাদের ইন্ডিয়ান ইস্যু অফিসের কাছে রিপোর্ট প্রদান করতে পারতাম। আমাদের ইন্ডিয়া অফিস থেকে একদিন বুদ্ধি দেয়া হলো আমি যেনো ইন্ডিয়ান মাল্টিপোল ভিসা নেই, এবং সকল বন্দর থেকে যেকোনো সময় যাতায়াত করতে পারি।

আমি রাও সাহেবের কাছে আমার কথা বললাম, আমি ইন্ডিয়ান মাল্টিপল ভিসা চাই, যাহার মাধ্যমে সমস্ত স্থল বন্দর দিয়ে বা বিমানবন্দর দিয়ে যেকোনো সময় যাতায়াত করতে পারি।

রাওসাহেব আমার কথা মন দিয়ে শুনলেন, পাসপোর্ট নিয়ে যেতে বললেন পাসপোর্ট নিয়ে গেলাম। রাওসাহেব এর প্রথম সচিব আমার ভিসা ফরমটি ফিলাপ করলেন। বললেন তিন দিন পরে যেতে, আমি যথারীতি তিনদিন পরে ইন্ডিয়ান হাইকমিশনে গেলাম, রাও সাহেবের সাথে চা খাওয়ার পরে, রাও সাহেব আমাকে নিয়ে গেলেন হাই কমিশনার মনিরাম ত্রীপদি সাহেবের রুমে।

হাই কমিশনারের রুমে যাওয়ার পরে বসতে বললেন, দু'জন লোককে বিদায় করলেন আমার সাথে কফি খাওয়ার সাথে সাথে কথা আরম্ভ করলেন, বললেন রাজ্জাক, আমরা মাল্টিপোল ভিসা ইসু করি তবে তা খুবই অল্প। মাল্টিপোল ভিসা ইনক্লুডিং অল বর্ডার, ইট ইস ভেরি রেআর ওয়ান। প্লিজ তোমার পাসপোর্ট গ্রহণ করো তোমাকে

অভিনন্দন

তুমি খুবই ভাগ্যবান ব্যক্তি, তোমার সাফল্য কামনা করি।

রাও সাহেবের রুমে আসার পরে রাও সাহেব বললেন আমাদের রপ্তানি বাড়ানোর জন্য রাজ্জাক আমাদের সাহায্য করবা তোমাদের যদি কিছু দরকার হয় আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে দেখব। আমি বললাম আমার ব্লক থেকে পণ্য বেশি আমদানি হলে আমাদের কোম্পানির রেভিনিউ বারবে এটা আমার কর্তব্য। আপনি কিছু চিন্তা করবেননা রাও সাহেব। রাও সাহেব বললেন তোমার যদি কোন ছোট ভাই কোনো আত্মীয়-স্বজন থাকে আমার কাছে নির্দ্বিধায় বলতে পারো আমি ইন্ডিয়ান স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে দেব, ভালোভাবে ইন্ডিয়ায় তারা পড়াশোনা করে আসবে। আমি সবিনয়ে বললাম এসবের কিছুই দরকার নাই রাও সাহেব, আমি আমার কর্তব্য কখনো অবহেলা করি না, আমার কাজ আমি করে যাব। রাওসাহেব এর সহযোগিতায় সেই সময়ে বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছিল। শুনেছি রাওসাহেব এখান থেকে বদলি হয়ে মরিসাচের রাষ্ট্রদূত হয়ে গেলেন।

আজ থেকে২০ বছর পরেও রাও সাহেবের সেই মুখ আমার হৃদয়ে ভাস্বর। নিজের দেশের স্বার্থে নিজের দেশের রপ্তানিকে ত্বরান্বিত করার জন্য একজন কূটনীতিকের কি ধরনের মনিটরিং, কি ধরনের লেখাপড়া তা প্রত্যক্ষ করেছিলাম, তা ছাড়াও তাঁর ছিল দেশের প্রতি একটা মমত্ববোধ অঙ্গীকার, যে অঙ্গীকার থেকে আমার মত অতি সাধারণ মানুষের সাথে কত সৌহার্দপূর্ণ পূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন এই অসাধারণ কূটনীতিক।

আমি আমার কর্ম জীবনে বহু দেশ ভ্রমণ করেছি বাংলাদেশের মিশনগুলো যদি রাও সাহেবের মত কর্মকর্তা থাকতেন তাহলে বোধহয় আমাদের বাণিজ্যিক কূটনীতি অনেক প্রসারিত হতো।

খুবই জানতে ইচ্ছে করে, হামিদ আলী রাও এখন কেমন আছেন। নিশ্চয়ই অবসর জীবন যাপন করছেন, তার দেশপ্রেম আমার মনে হয় আজও অটুট আছে।

নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবারই দেশের জন্য কিছু করা উচিত, দেশের স্বার্থে দেশের প্রয়োজনে নিজের জীবনকে নিয়োজিত রাখা উচিত ।