প্রিয় প্রজন্ম || Priyo Projonmo

আবার নড়াইল, এই বাংলাদেশ আমাদের না

ফজলুল বারী

প্রকাশিত: ১০:৪৭, ১৭ জুলাই ২০২২

আবার নড়াইল, এই বাংলাদেশ আমাদের না

আবার সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে নড়াইলে। কাঁদছেন সেখানকার ভীতসন্ত্রস্ত হিন্দু মায়েরা-মেয়েরা। আবার বুক চাপড়ে জানতে চাইছেন জন্মভূমি এই দেশটা কী আর তাদের আছে? সেখান থেকে এসেছে ভীতিকর সব ছবি। দুগ্ধপোষ্য অবুঝ এক শিশু অবাক তাকিয়ে দেখছে তাঁর দিদিমা কাঁদছেন!

কাঁদবেতো তার মতো বাচ্চারা। দিদিমা কাঁদবেন কেনো? দেশে সাম্প্রদায়িক হামলার নতুন প্রতীকি যেনো এই ছবি। যা দেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষজনকে অনেক দিন পোড়াবে। তাড়িয়ে বেড়াবে। কারন এই বাংলাদেশতো আমাদের না। এরজন্যে এখানে মুক্তিযুদ্ধ হয়নি।

হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ খ্রিস্টান মিলে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে। আর সাম্পদায়িক হামলা যারা করছে এরাতো বাংলাদেশই চায়নি। আজ পর্যন্ত এরা বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গায় না! এবার নড়াইলের দিঘলিয়াবাসীও দেখলো শুক্রবার দিনটা তাদেরও হাতছাড়া হয়ে গেছে!

এখন শুক্রবার জুম্মার নামাজে জমায়েত মুসল্লিরা হিন্দু দেখে তাদের ওপর হামলা-আক্রমন চালায়! শুক্রবার এখন হিন্দুদের ওপর আক্রমনেরও সাপ্তাহিক দিবস! ক্ষমতাসীন জোটের শরীক দলের নেতা রাশেদ খান মেনন হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, চারদিকে তাকালে মনে হয় দেশটা আফগানিস্তান হয়ে গেছে, বাংলাদেশ নয়!

যে ঘটনাগুলো ঘটছে এগুলো বাংলাদেশের চরিত্র নয়। এলাকার এমপি মাশরাফি বিন মর্তুজা বলেছেন, এই নড়াইলকে তিনি চেনেননা। আসলে এখন টেলিভিশনে আমরা বিদেশ থেকে বাংলাদেশের যে সব ছবি দেখি বেশিরভাগ মানুষজনের পোশাকে-চেহারায় দেশটাকে অচেনা মনে হয়!

মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরে বাংলাদেশটা দেখতে এ রকম ছিলোনা। এই কিছুদিন আগে নড়াইলের ডিসি-এসপির উপস্থিতিতে একজন হিন্দু শিক্ষকের গলায় জুতোর মালা পরানোর তাজ্জব ঘটনা নিয়ে দেশজুড়ে স্পর্শকাতর প্রতিক্রিয়া ঘটেছে। ডিসি-এসপি যেন অপেক্ষা করছিলেন হিন্দু শিক্ষকটির গলায় জুতোর মালা পরিয়ে দেয়া হয়ে গেলে উগ্র মৌলবাদী মব ঠান্ডা হবে!

এরপর সবাই পদ্মা সেতুর উদ্বোধন-ঈদ-বাড়ি যাওয়া-কুরবানি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলো। সেই শিক্ষককে অবিশ্বাস্য অপমানের ঘটনার ফলোআপ কী এর খোঁজ-খবর নিতে আমরা ভুলেই গেলাম। বাংলাদেশে এমন অনেক ঘটনার ভিড়ে আগের ঘটনা প্রতিকার বিহীন হারিয়ে যায়!

এবার নড়াইলের দিঘলিয়ায় একজন আকাশ সাহা নবীকে কটাক্ষ করেছে এমন একটি অভিযোগে অনেকগুলো হিন্দু বাড়ি-সম্পত্তি-মন্দিরে হামলা-আগুন দেয়া হলো! ফেসবুকে ভাইরাল ভিডিও ক্লিপে দেখা গেলো শুক্রবার বাদ জুম্মা হিন্দুদের বিরুদ্ধে উত্তেজনা সৃষ্টির সময়েও সেখানে পুলিশ উপস্থিত ছিল!

কাজেই এই ঘটনাও প্রশাসনের অজ্ঞাতসারে ঘটেছে বলা যাবেনা। ঘটনা ঘটেছে প্রশাসনের অবহেলা ও ঢিলেমিতে। এবারকার ঘটনার খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেলো পুরো ঘটনা সাজানো। আকাশ সাহার নামের আইডিটাই একদিন আগে তৈরি করা! সাহাদের তাড়িয়ে তাদের জমি সম্পত্তি কারা কিনতে চাইছে?

আকাশ সাহা নামের ছেলেটি অবমাননাকর কী বলেছেন বা লিখে পোষ্ট দিয়েছেন তা কেউ বলতে পারলোনা। একজন নাকি হিন্দু দেবদেবীকে কটাক্ষ করে পোষ্ট দিয়েছে, আকাশ সাহা সেখানে মন্তব্য করেছিলেন। যেন মুসলমান যেহেতু সংখ্যাগুরু, দেব-দেবী সম্পর্কে যা খুশি লিখতেই পারে!

কিন্তু ‘ওই ‘একজ’ হিন্দু দেব-দেবী নিয়ে কী লিখেছিলেন সেই পোষ্টের স্ক্রিনশট অনেক চেষ্টা করেও জোগাড় করতে পারিনি। মন্তব্য আকারে আকাশ সাহা’র বক্তব্য যেটা বলা হচ্ছে সেই কাজটিও দূর্বল কাঁচা-হাতের কাজ! চিত্রনাট্যটাই অনন্ত জলিলের কথিত একশ কোটি টাকা বাজেটের ছবির গল্পের মতো দূর্বল!

একজনের আইডিতে আকাশ সাহার কথিত মন্তব্যের বিষয়টি এমনভাবে ফটোশপ করে জুড়ে দেয়া যে ওই ব্যক্তি হয়তো বিষয়টি জানেইনা! তার আইডিতে গিয়ে হিরো আলমের গানের ভিডিও ক্লিপ পাওয়া গেছে। এ ঘটনাটির আগেপরের কোন পোষ্ট পাওয়া যায়নি।

দিঘলিয়ার ঘটনার দিন অনেকে ইনবক্সে ঘটনার ভিডিও ক্লিপ পাঠাচ্ছিলেন। কিন্তু সমকাল-বাংলা ট্রিবিউনের রিপোর্ট পড়ে বিভ্রান্ত হই। দুটি রিপোর্টই একই তথ্যের। অথবা একজনের লেখা। যা পড়ে ধারনা জন্মাবে দোষ আকাশ সাহার। এরজন্যে ব্যাটা পালিয়েছে। ছেলের বাপকে তাই পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে!

অথবা সেই হিন্দু শিক্ষকের গায়ে জুতোর মালা পরানোর মতো উত্তেজনা প্রশমনে এটাই ছিল প্রশাসনের কৌশল। অথবা এভাবে ছেলের বাবা’কে সেই মবের আক্রমন থেকে বাঁচাতে নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে! আমাকে একজন লিখেছেন, ছেলে অপরাধ করে থাকলে বাবা’কে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে কেনো!

জবাবে মুখস্ত লিখেছি, এটাইতো বাংলাদেশের স্টাইল। দিঘলিয়ার ঘটনার এখন পর্যন্ত একমাত্র পজিটিভ ঘটনা হলো, এলাকার এমপি মাশরাফির আন্তরিকতা। ঘটনায় মর্মাহত-নিন্দা-এমপি হিসাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলা সহ তাঁর তাৎক্ষনিক ভূমিকা জানিয়ে তিনি বিস্তারিত ফেসবুকে লিখেছেন।

এলাকার মানুষজনের কাছে ছুটে গিয়ে সবাইকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছেন। তাকে ঘিরে জনতার ভিড়কে উদ্দেশ্য করে বলেছেন আপনারা সবাই রুখে দাঁড়ালে এত ক্যামেরা-মোবাইলে নিয়ে ছুটে এলে তারা এমন ঘটনার সাহস পায়না। যে আক্রমনের ঘটনা ঘটেছে এর ক্ষতিপূরন করা যাবেনা।

মাশরাফি বলেছেন, তিনি ছোটবেলা থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যে নড়াইল দেখে বড় হয়েছেন, এই নড়াইল সেই নড়াইল নয়। যা বলেননি তাহলো এস এম সুলতানের নড়াইল, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র ব্রাহ্মনবাড়িয়া এমন বেছে বেছে শিল্প সংস্কৃতির চারনভূমি দেখে দেখেই মৌলবাদীরা আক্রমনের টার্গেট করেছে!

আসুন নবারুন ভট্টাচার্যের কবিতাটা আবার সবাই মিলে দূঃখ-ক্ষোভ নিয়ে পড়িঃ

যে পিতা সন্তানের লাশ সনাক্ত করতে ভয় পায়
আমি তাকে ঘৃণা করি-
যে ভাই এখনও নির্লজ্জ স্বাভাবিক হয়ে আছে
আমি তাকে ঘৃণা করি-
যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরাণী
প্রকাশ্য পথে এই হত্যার প্রতিশোধ চায় না
আমি তাকে ঘৃণা করি-
আটজন মৃতদেহ
চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে
আমি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাচ্ছি
আট জোড়া খোলা চোখ আমাকে ঘুমের মধ্যে দেখে
আমি চীৎকার করে উঠি
আমাকে তারা ডাকছে অবেলায় উদ্যানে সকল সময়
আমি উন্মাদ হয়ে যাব
আত্মহ্ত্যা করব
যা ইচ্ছা চায় তাই করব।

কবিতা এখনই লেখার সময়
ইস্তেহারে দেয়ালে স্টেনসিলে
নিজের রক্ত অশ্রু হাড় দিয়ে কোলাজ পদ্ধতিতে
এখনই কবিতা লেখা যায়
তীব্রতম যন্ত্রনায় ছিন্নভিন্ন মুখে
সন্ত্রাসের মুখোমুখি-ভ্যানের হেডলাইটের ঝলসানো আলোয়
স্থির দৃষ্টি রেখে
এখনই কবিতা ছুঁড়ে দেওয়া যায়
’৩৮ ও আরো যা যা আছে হত্যাকারীর কাছে
সব অস্বীকার করে এখনই কবিতা পড়া যায়

লক-আপের পাথর হিম কক্ষে
ময়না তদন্তের হ্যাজাক আলোক কাঁপিয়ে দিয়ে
হত্যাকারীর পরিচালিত বিচারালয়ে
মিথ্যা অশিক্ষার বিদ্যায়তনে
শোষণ ও ত্রাসের রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে
সামরিক-অসামরিক কর্তৃপক্ষের বুকে
কবিতার প্রতিবাদ প্রতিধ্বনিত হোক
বাংলাদেশের কবিরাও
লোরকার মতো প্রস্তুত থাকুক
হত্যার শ্বাসরোধের লাশ নিখোঁজ হওয়ার স্টেনগানের গুলিতে সেলাই হয়ে
যাবার জন্য প্রস্তত থাকুক
তবু কবিতার গ্রামাঞ্চল দিয়ে
কবিতার শহরকে ঘিরে ফেলবার একান্ত দরকার।
এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না
এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না
এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না
এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না
আমি আমার দেশকে ফিরে কেড়ে নেব
বুকের মধ্যে টেনে নেব কুয়াশায় ভেজা কাশ বিকেল ও ভাসান
সমস্ত শরীর ঘিরে জোনাকি না পাহাড়ে পাহাড়ে জুম
অগণিত হৃদয় শস্য, রূপকথা ফুল নারী নদী
প্রতিটি শহীদের নামে এক একটি তারকার নাম দেব ইচ্ছে মতো
ডেকে নেব টলমলে হাওয়া রৌদ্রের ছায়ায় মাছের চোখের মত দীঘি
ভালোবাসা-যার থেকে আলোকবর্ষ দুরে জন্মাবধি অচ্ছুৎ হয়ে আছি-
তাকেও ডেকে নেব কাছে বিপ্লবের উৎসবের দিন।

হাজার ওয়াট আলো চোখে ফেলে রাত্রিদিন ইনটারোগেশন
মানি না
নখের মধ্যে সূঁচ বরফের চাঙড়ে শুইয়ে রাখা
মানি না
পা বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা যতক্ষণ রক্ত ঝরে নাক দিয়ে
মানি না
ঠোঁটের ওপরে বুট জ্বলন্ত শলাকায় সারা গায় ক্ষত
মানি না
ধারালো চাবুক দিয়ে খন্ড খন্ড রক্তাক্ত পিঠে সহসা আ্যালকোহল
মানি না
নগ্নদেহে ইলেকট্রিক শক কুৎসিৎ বিক্রত যৌন অত্যাচার
মানি না
পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা খুলির সঙ্গে রিভলবার ঠেঁকিয়ে গুলি
মানি না
কবিতা কোন বাধাকে স্বীকার করে না
কবিতা সশস্ত্র কবিতা স্বাধীন কবিতা নির্ভীক।
চেয়ে দেখো মায়কোভস্কি হিকমেত নেরুদা আরাগঁ এলুয়ার
তোমাদের কবিতাকে আমরা হেরে যেতে দিইনি
বরং সারাটা দেশ জুড়ে নতুন একটা মহাকাব্য লেখবার চেষ্টা চলছে
গেরিলা ছন্দে রচিত হতে চলেছে সকল অলংকার।
গর্জে উঠুক দল মাদল
প্রবাল দ্বীপের মত আদিবাসী গ্রাম
রক্তে লাল নীলক্ষেত
শঙ্খচূড়ের বিষ-ফেনা মুখে আহত তিতাস
বিষাক্ত মৃত্যুসিক্ত তৃষ্ঞায় কুচিলা
টণ্কারের সূর্য অন্ধ উৎক্ষিপ্ত গান্ডীবের ছিলা
তীক্ষ্ম তীর হিংস্রতম ফলা-
ভাল্লা তোমার টাঙ্গি পাশ
ঝলকে ঝলকে বল্লম চর-দখলের সড়কি বর্শা
মাদলের তালে তালে রক্তচক্ষু ট্রাইবাল টোটেম
বন্দুক কুরকি দা ও রাশি রাশি সাহস
এত সাহস যে আর ভয় করে না
আরো আছে ক্রেন, দাঁতালো বুলডজার বনভয়ের মিছিল
চলামান ডাইনামো টারবাইন লেদ ও ইনজিন
ধ্বস-নামা কয়লার মিথেন অন্ধকারে কঠিন হীরার মতো চোখ
আশ্চর্য ইস্পাতের হাতুড়ি
ডক জুটমিল ফার্ণেসের আকাশে উত্তোলিত সহস্র হাত
না ভয় করে না
ভয়ের ফ্যাকাশে মুখ কেমন অচেনা লাগে
যখন জানি মৃত্যু ভালোবাসা ছাড়া কিছু নয়।
আমাকে হ্ত্যা করলে
বাংলার সব কটি মাটির প্রদীপে শিখা হয়ে ছড়িয়ে যাব
আমার বিনাশ নেই-
বছর বছর মাটির মধ্য হতে সবুজ আশ্বাস হয়ে ফিরে আসব
আমার বিনাশ নেই-
সুখে থাকব, দুঃখে থাকব সন্তান-জন্মে সৎকারে
বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ততদিন
মানুষ যতদিন থাকবে ততদিন।